হাল ছাড়েননি কল্পনা চাকমার বন্ধুরা!
- Get link
- X
- Other Apps
ইলিরা দেওয়ান
১২ জুন ২০১৬, ০০:২১
আপডেট: ১২ জুন ২০১৬, ০০:
আপডেট: ১২ জুন ২০১৬, ০০:
কল্পনা চাকমা। নতুন করে তাঁর পরিচিতি দেওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। ২০ বছর ধরে কল্পনা চাকমা স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর আসনে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অপহরণের আগ পর্যন্ত কল্পনা চাকমা তাঁর ধারালো নেতৃত্বে শাণ দিয়েছিলেন পাহাড়ের গায়ে। কল্পনার সেই শাণে ভয় পেয়ে দিনের বেলায় নয়, গভীর রাতের আঁধারে কাপুরুষের মতো তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় একটি মহল। কল্পনা চাকমার ভাইয়েরা শুরু থেকে দাবি করে আসছেন সে রাতে তাঁরা অপহরণকারীদের কয়েকজনকে চিনতে পেরেছেন। সেদিন নদীর ধারে কুয়ার ঘাট পর্যন্ত চোখ বাঁধা অবস্থায় ভাইয়ের হাত ধরেই ছিলেন কল্পনা চাকমা। এরপর গুলির শব্দে ভাইবোন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেই যে ভাইয়ের হাত ফসকে কল্পনা বেরিয়ে গেলেন, ২০ বছর ধরে সেই হাত খুঁজে চলেছেন কল্পনার ভাইয়েরা।
আমরা যদি একটু পেছনে ঘুরে কল্পনা চাকমা অপহরণের আগের বছরের কথা মনে করি, তাহলে আমাদের চোখের সামনে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কয়েকজন পুলিশ সদস্যের হাতে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনের নির্মমভাবে ধর্ষণের পর হত্যার শিকারের কথা ভেসে ওঠে। এ হত্যাকাণ্ডে সে সময়ে দিনাজপুরসহ সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়েছিল। ইয়াসমিনের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আরও সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। ইয়াসমিন হত্যার বিচার দুই বছরের মধ্যে হয়েছিল।
ইয়াসমিন ঘটনার পর বছর না ঘুরতেই কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেন। কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদ ও তাঁকে উদ্ধারের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও তৎকালীন পাহাড়ি গণপরিষদ ২৭ জুন ১৯৯৬ তারিখে বাঘাইছড়িতে সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। অবরোধের সময় মিছিল বের করা হলে সেই মিছিলে হামলা চালানো হয় এবং রূপন চাকমা, মনতোষ চাকমা, সমরবিজয় চাকমা ও সুকেশ চাকমাকে গুম করে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত স্কুলছাত্র রূপন চাকমার লাশ রাস্তা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয় এবং বাকিরা গুচ্ছগ্রামের পাশ দিয়ে প্রাণভয়ে পালানোর সময় তাঁদের ধরে নিয়ে গুম করে দেওয়া হয়। ২৭ জুনের পর থেকে এই চারজনকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইয়াসমিন ও কল্পনা চাকমা দুজনই এ দেশের নাগরিক এবং দুজনই শ্রমঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্য। তবে পার্থক্য হলো ইয়াসমিন বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি আর কল্পনা এ দেশের ÿক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি। আলোচিত দুটি ঘটনায়ই দেশ ফুঁসে উঠেছিল। ইয়াসমিনের ঘটনায় সুবিচার পেলেও কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনায় আমরা ২০টি বছর ধরে প্রহর গুনছি। হয়তো এই অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ হবে কিন্তু কল্পনার পরিবার, তাঁর সহযোদ্ধা, বন্ধু-শুভার্থীরা এখনো হাল ছাড়েননি। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই কল্পনার উপস্থিতি যেন আমাদের কাছে আরও বেশি নিবিড় হচ্ছে। তাই সরকার বা বিশেষ মহল যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, কল্পনার চেতনা কোনো দিন মুছে ফেলার মতো শক্তি অর্জন করতে পারবে না। কল্পনা সব সময় স্বমহিমায় আমাদের মাঝে ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
কল্পনা চাকমা একটি মশালের নাম। যে মশালের আলো পাহাড়ের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। খাগড়াছড়ির ধুধুকছড়া থেকে বান্দরবানের ঘুনধুম, বাঘাইছড়ির সাজেক থেকে রাঙামাটির ঘিলাছড়ি সর্বত্রই কল্পনার চেতনা ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ে যেখানে নারীর ওপর অন্যায়ের কালো থাবা পড়েছে, সেখানে পাহাড়ি নারীরা প্রতিবাদে জেগে উঠেছেন। হয়তো এ প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্ষমতার শিখরে বসে থাকা ব্যক্তিদের কান অবধি পৌঁছায় না, কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা উচ্চশিক্ষার ভারী ডিগ্রি পাহাড়ের গ্রামের নারীদের আলোকিত করেনি বটে, কিন্তু তাঁদের মনোজগৎ অন্য আলোয় ভরে আছে, যে আলোয় তাঁরা নারী সমাজকে আলোকিত করতে শুরু করেছেন।
বর্তমানে পাহাড়ি নারীরা সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। জাতিগত নিপীড়নে পাহাড়ি নারীরা যেমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া কিছু অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও পাহাড়ি নারীরা সজাগ হচ্ছেন। কল্পনার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে এটুকু অন্তত দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করতে পারি, কল্পনা থাকলে পাহাড়ের নারীদের এ অগ্রযাত্রায় তিনি প্রথম সারিতেই থাকতেন।
কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাটি নিছক কোনো নারী অপহরণ–সংক্রান্ত ঘটনা নয়। কারণ, অপহরণের সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেত্রী ছিলেন। ২০ বছর ধরে কল্পনা অপহরণ মামলায় শুধু তদন্ত-তদন্ত খেলা চলছে। এত বছর পরেও কল্পনাকে উদ্ধার করতে না পারা ও অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনতে পারার ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রকেই এর দায় বহন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্তে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ দেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাদেরই একজন কৃতী সন্তান শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। স্বাধীনতার চার দশক পরে আমরা সেলিনা পারভীন হত্যার বিচার পেয়েছি। তাই পাহাড়ের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারও একদিন এই বাংলার মাটিতেই হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ইলিরা দেওয়ান: সাবেক সভানেত্রী, হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
আমরা যদি একটু পেছনে ঘুরে কল্পনা চাকমা অপহরণের আগের বছরের কথা মনে করি, তাহলে আমাদের চোখের সামনে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কয়েকজন পুলিশ সদস্যের হাতে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনের নির্মমভাবে ধর্ষণের পর হত্যার শিকারের কথা ভেসে ওঠে। এ হত্যাকাণ্ডে সে সময়ে দিনাজপুরসহ সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়েছিল। ইয়াসমিনের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আরও সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। ইয়াসমিন হত্যার বিচার দুই বছরের মধ্যে হয়েছিল।
ইয়াসমিন ঘটনার পর বছর না ঘুরতেই কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেন। কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদ ও তাঁকে উদ্ধারের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও তৎকালীন পাহাড়ি গণপরিষদ ২৭ জুন ১৯৯৬ তারিখে বাঘাইছড়িতে সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। অবরোধের সময় মিছিল বের করা হলে সেই মিছিলে হামলা চালানো হয় এবং রূপন চাকমা, মনতোষ চাকমা, সমরবিজয় চাকমা ও সুকেশ চাকমাকে গুম করে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত স্কুলছাত্র রূপন চাকমার লাশ রাস্তা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয় এবং বাকিরা গুচ্ছগ্রামের পাশ দিয়ে প্রাণভয়ে পালানোর সময় তাঁদের ধরে নিয়ে গুম করে দেওয়া হয়। ২৭ জুনের পর থেকে এই চারজনকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইয়াসমিন ও কল্পনা চাকমা দুজনই এ দেশের নাগরিক এবং দুজনই শ্রমঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্য। তবে পার্থক্য হলো ইয়াসমিন বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি আর কল্পনা এ দেশের ÿক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি। আলোচিত দুটি ঘটনায়ই দেশ ফুঁসে উঠেছিল। ইয়াসমিনের ঘটনায় সুবিচার পেলেও কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনায় আমরা ২০টি বছর ধরে প্রহর গুনছি। হয়তো এই অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ হবে কিন্তু কল্পনার পরিবার, তাঁর সহযোদ্ধা, বন্ধু-শুভার্থীরা এখনো হাল ছাড়েননি। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই কল্পনার উপস্থিতি যেন আমাদের কাছে আরও বেশি নিবিড় হচ্ছে। তাই সরকার বা বিশেষ মহল যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, কল্পনার চেতনা কোনো দিন মুছে ফেলার মতো শক্তি অর্জন করতে পারবে না। কল্পনা সব সময় স্বমহিমায় আমাদের মাঝে ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
কল্পনা চাকমা একটি মশালের নাম। যে মশালের আলো পাহাড়ের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। খাগড়াছড়ির ধুধুকছড়া থেকে বান্দরবানের ঘুনধুম, বাঘাইছড়ির সাজেক থেকে রাঙামাটির ঘিলাছড়ি সর্বত্রই কল্পনার চেতনা ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ে যেখানে নারীর ওপর অন্যায়ের কালো থাবা পড়েছে, সেখানে পাহাড়ি নারীরা প্রতিবাদে জেগে উঠেছেন। হয়তো এ প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্ষমতার শিখরে বসে থাকা ব্যক্তিদের কান অবধি পৌঁছায় না, কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা উচ্চশিক্ষার ভারী ডিগ্রি পাহাড়ের গ্রামের নারীদের আলোকিত করেনি বটে, কিন্তু তাঁদের মনোজগৎ অন্য আলোয় ভরে আছে, যে আলোয় তাঁরা নারী সমাজকে আলোকিত করতে শুরু করেছেন।
বর্তমানে পাহাড়ি নারীরা সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। জাতিগত নিপীড়নে পাহাড়ি নারীরা যেমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া কিছু অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও পাহাড়ি নারীরা সজাগ হচ্ছেন। কল্পনার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে এটুকু অন্তত দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করতে পারি, কল্পনা থাকলে পাহাড়ের নারীদের এ অগ্রযাত্রায় তিনি প্রথম সারিতেই থাকতেন।
কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাটি নিছক কোনো নারী অপহরণ–সংক্রান্ত ঘটনা নয়। কারণ, অপহরণের সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেত্রী ছিলেন। ২০ বছর ধরে কল্পনা অপহরণ মামলায় শুধু তদন্ত-তদন্ত খেলা চলছে। এত বছর পরেও কল্পনাকে উদ্ধার করতে না পারা ও অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনতে পারার ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রকেই এর দায় বহন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্তে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ দেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাদেরই একজন কৃতী সন্তান শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। স্বাধীনতার চার দশক পরে আমরা সেলিনা পারভীন হত্যার বিচার পেয়েছি। তাই পাহাড়ের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারও একদিন এই বাংলার মাটিতেই হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ইলিরা দেওয়ান: সাবেক সভানেত্রী, হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
সূত্র- প্রথম আলো
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment