আষাঢ়ী পূর্ণিমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য-ভিক্খু তি. রত্তন জোতি
“নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্স”
আসছে ৩ অগাস্ট শুভ আষাঢ়ী পুর্ণিমা। বৈশাখী পূর্ণিমার মতো এটিও সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপুর্ণ দিন। বিশ্বের সকল থেরবাদ বৌদ্ধ সম্প্রদায় ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য সহকারে এ দিনটি উদ্যাপন করা হবে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দনা, পূজা, সংঘদান, অষ্টপরিষ্কারদান, বুদ্ধমূর্তিদান, ধর্ম দেশনা, ধর্ম শ্রবণ, শীল গ্রহণ, ভাবনা ও প্রদীপ পূজা সহ নানাবিধ পূণ্যময় অনুষ্ঠানাদির আয়োজনের মাধ্যমে এ দিনটি উদ্যাপিত হবে। এ দিনটি ছয়টি প্রধান কারণে অত্যন্ত মহান। নিচে সেগুলো সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হল:
১। সিদ্ধার্থের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ : এ পবিত্র পুর্ণিমা তিথিতে সিদ্ধার্থ মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। রাজা শুদ্ধোধনের প্রধান মহিষী মহামায়া পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমার রজনীতে রাজশয্যায় শায়িত অবস্হায় গভীর নিদ্রায় অচেতন, তখন মহারাণী শেষ রাতে একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন স্বর্গ হতে চারজন দেবতা এসে পালঙ্কসহ তাঁকে কাঁধে করে হিমালয় চূড়ায় নিয়ে গিয়ে দেবিগণ তাঁকে তথায় পবিত্র জলে স্নান করান। অতপর এক সাদা হাতি শুন্ডে এক সাদা পদ্ম নিয়ে তাঁর দক্ষিণ কুক্ষি ভেদ করে বিদ্যুতের ন্যায় জঠরে প্রবেশ করে। হঠাৎ মহারাণীর ঘুম ভাঙার পর মহারাজকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালে তিনি প্রভাতে দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ডাকলেন এবং স্বপ্নের শুভাশুভ জিজ্ঞাসা করলেন। ব্রাহ্মণগণ বললেন- মহারাজ সাদা হাতির বেশে মহারাণীর জঠরে মহাসত্ত্ব আগমন করেছেন। এভাবেই সিদ্ধার্থ পবিত্র আষাঢ়ী পুর্ণিমার আলোকোজ্জ্বল রজনীতে তাঁর মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন।
২। সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ : সিদ্ধার্থের বয়স যখন ঊনত্রিশ বছর তখন পিতা শুদ্ধোধনের অনুমতিক্রমে নগর ভ্রমণে বের হয়ে বৃদ্ধ, রোগী , মৃতদেহ ও সন্ন্যাসী এ চারটি দৃশ্য দেখতে পান। জরা-ব্যাধি-মুত্যু এ তিনটি দুশ্য তাকে চিন্তিত করে তোলে। এসব দর্শনে মানব জীবনের অনিবার্য অনন্ত দুঃখ রাশির চিত্র তাঁর মানসপটে আয়নার মত ভেসে উঠল। তিনি জিবনের দুঃখ মুক্তির উপায় উদ্ভাবনের জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কিন্তু কি ভাবে? সন্যাসীর শান্ত সংযত ভাব তাঁকে মুগ্ধ করল। সংসারের ভোগবিলাস ত্যাগ করে মনে মনে সন্যাসব্রতই বেছে নিলেন। এর মধ্যে পুত্র রাহুলের জন্মে মায়ার বন্ধন বৃদ্ধির ভয়ে আনন্দ লাভের পরিবর্তে গৃহত্যাগের বাসনা তীব্র হয়ে উঠল। আর দেরি না করে সে দিনের পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমার গভীর রাতে তিনি গৃহত্যাগ করেন।
৩। ধর্মচক্র প্রবর্তন : ছয় বছর কঠোর সাধনার পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে যে মহান সম্বোধিজ্ঞান তিনি বুদ্ধগয়ায় লাভ করেন, তা ছিল অত্যন্ত গুরুগম্ভীর, দুরনুবোধ্য, তর্কাতীত, শান্ত ও উন্নত। সেজন্যে বুদ্ধ প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও পরে দুঃখক্লিষ্ট জীব-জগতের প্রতি করুণা পরবশ হয়ে তিনি নবলব্দ ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু কৌন্ডিণ্য, ভদ্রিয়, ভপ্প, মহানাম, ও অশ্বজিত এর নিকট ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র দেশনার মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ ধর্ম তিনি প্রচার করেন। তিনি তাঁদেরকে ভোগে আসক্তি ও আত্ম নিগ্রহ বা কঠোর কৃচ্ছসাধন এ দুই অন্ত বর্জন করে মধ্যম পন্হা অবলম্বন করার উপদেশ প্রদান করেন। কারণ এদের কোনটায় দুঃখমুক্তির সহায়ক নয়। এ দুই অন্তের মধ্যবর্তী অবস্হা অর্থাৎ যথারীতি পরিমিত আহার গ্রহণ করে সবল দেহমনে ধ্যন-সাধনায় রত থেকে অর্হত্বলাভে তৎপর হওয়া হচ্ছে মধ্যম পন্হা। বুদ্ধ তাদেরকে আরও বলেন- “হে ভিক্ষুগণ, দুঃখ সত্যকে জান, দুঃখের উৎপত্তির কারণ বা দুঃখ সমুদয় সত্যকে জান, দুঃখকে নিঃশেষে ধ্বংস সাধন অর্থাৎ নিরোধ সত্যকে জান এবং দুঃখ ধ্বংসের উপায় বা মার্গ সত্যকে জান।” এ মার্গসত্য হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যথা- সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি। এ মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে দুঃখ ধ্বংস করে জন্ম-মৃত্যুর অতীত হয়ে পরম শান্তি নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, এ ধর্ম শ্রবণ করে কৌন্ডিণ্য ভিক্ষু অর্হত প্রাপ্ত হন এবং আঠারো কোটি দেব-ব্রহ্মার ধর্মচক্ষু উৎপন্ন হয়।
৪। যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন : ঋদ্ধিলাভী ভিক্ষুদের ঋদ্ধি প্রদর্শন বুদ্ধকর্তৃক নিষিদ্ধ করার পরেও বিপথগামীদের সত্যপথে আনয়নের উদ্দেশ্যে মগধরাজ বিম্বিসারের বিনম্র অনুরোধে বুদ্ধ স্বয়ং পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসে শ্রাবস্তীর জনসমক্ষে যমক প্রাতিহার্য অর্থাৎ দুই বিপরীত মুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। তথাকার রাজোদ্যানের মালী গন্ড বুদ্ধকে একটি পাকা আম দান করলে তিনি গন্ডকে তা মাটিতে পুতে রাখার আদেশ দেন। বুদ্ধ এর উপড় হাত ধুয়ে জল দেয়া মাত্র তা প্রায় পঞ্চাশ হাত উঁচু বিশাল এক আম্র বৃক্ষে পরিণত হয়। এরপর বুদ্ধ এ স্হানে অলৌকিক ক্ষমতাবলে শুণ্যের উপড় একটি মণিময় বিহার ভূমি সৃষ্টি করে তাতে আরোহণ পূর্বক যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন করেন। প্রথমত বুদ্ধের উর্দ্ধাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হয় এবং নিম্নাঙ্গ থেকে বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। আবার উর্দ্ধাঙ্গ থেকে বারিধারা এবং নিম্নাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা বের হতে থাকে। এরপর ডানপাশ ও বামপাশ থেকে দুই বিপরীতমুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। এভাবে মোট বাইশ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। উপস্থিত জনতা তখন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন বুদ্ধের প্রতি।
৫। বুদ্ধের তাবতিংস স্বর্গে গমণ : সপ্তম বর্ষাবাস বুদ্ধ তাঁর স্বর্গীয় মাতা মহামায়াকে ধর্মোপদেশ দানে নির্বাণ লাভে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তাবতিংস স্বর্গে দেবতাদের সাথে যাপন করেন। অলৌকিক ক্ষমতা বলে বুদ্ধের তাবতিংস গমণের দিনও ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। তাঁর জন্মের সপ্তাহকাল পরে তাঁর মাতা মহামায়া দেহ ত্যাগ করে তথায় উৎপন্ন হন। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশতঃ দীর্ঘ তিন মাস তিনি সেখানে অবস্হান করে অভিধর্ম দেশনা করেন।
৬। ভিক্ষু সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান : আষাঢ়ী পূর্ণিমার প্রধান ও সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল- এই দিনে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিনয় বিধান অনুযায়ী ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করেন এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমা হতে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস এক বিহারে অবস্হান করেন। এই তিন মাস ভিক্ষুরা ধ্যান-সাধনা ও জ্ঞানচর্চায় রত থেকে নিজেকে বুদ্ধের যোগ্য শিষ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান। এই বর্ষাবাসের ওপড় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রথমত এই তিনমাস বিনয় সম্মত বর্ষাবাসের দ্বারা ভিক্ষুদের বয়স নির্ধারিত হয়। দ্বিতীয়ত বর্ষাবাস উদ্যাপনকারী ভিক্ষু দায়কদের থেকে চতুর্প্রত্যয় এবং সংশ্লিষ্ট বিহারে থাকার অধিকার লাভ করেন। তৃতীয়ত একমাত্র বর্ষাব্রত উদ্যাপনকারী ভিক্ষুই দায়কদের থেকে কঠিন চীবর লাভ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। গৃহীদের মধ্যে অনেকেই বর্ষাবাসের এ তিনমাস ব্যাপী দান, ধর্মালোচনা, উপোসথ শীল পালন, এবং কেউ কেউ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ভিক্ষুদের সাথে ধ্যান-ভাবনায় রত থাকেন। সর্বোপরি বর্ষাবাসের পর পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য সহকারে বহুজনের হিত সুখের উদ্দেশ্যে এই সদ্ধর্ম সর্বদিকে প্রচার করতে মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন।
অতএব, বলতে হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অনেক। এই পবিত্র তিথি বিবিধ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত বিধায় সারা বিশ্বের বৌদ্ধ জনগণ শ্রদ্ধাভরে পালন করে থাকেন। ছয়টি অনন্য মহিমায় মহিমান্বিত পবিত্র আষাঢ়ী পুর্ণিমার স্নিগ্ধ জোছনাধারায় ধুয়ে যাক মানুষের সমস্ত ক্লেশরাশি। মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হোক সকলের অন্তর।
“সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু”
জগতের সকল প্রাণি সুখি হোক।
সাধু সাধু সাধু
[লেখাটি ভিক্খু তি. রত্তন জোতি ২০১৫ সালে লেখা হতে সংকলিত।]
Comments
Post a Comment