বিজিবি কর্তৃক জুম্ম হত্যায় বিচার না হলেও সেটেলার বাঙালি হত্যায় বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহার:
বিজিবি কর্তৃক জুম্ম হত্যায় বিচার না হলেও সেটেলার বাঙালি হত্যায় বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহার: সাম্প্রদায়িকতার জ্বাজ্জল্য উদাহরণ |
গত ৩ মার্চ ২০২০ খাগড়াছড়িতে বিজিবি ও গ্রামবাসীর সংঘর্ষে বিজিবি একজন সদস্য এবং ৪ জন সেটেলার বাঙালি গ্রামবাসীকে বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনার জেরে গত ৪ মার্চ ২০২০ খাগড়াছড়ি থেকে বিজিবি ক্যাম্প অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অআদিবাসী বা বাঙালি হত্যার পর বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, অনলাইন পোর্টালগুলোতে জোরেশোরে বা ফলাওভাবে প্রচার করতে দেখা যায়। সেই সাথে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবাদ ও এই বিষয়ে প্রচার প্রচারণাও বেশ চোখে পড়ার মত বলা যায়। সুতরাং, প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক জুম্ম আদিবাসী হত্যায় কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় না ও জুম্ম আদিবাসী হত্যা হলে অনলাইন পোর্টালগুলোতে তেমন কোন প্রচার প্রচারণা দেখা যায় না এবং নাগরিক সমাজ এই বিষয়ে জোরেশোরে প্রতিবাদের কোন পদক্ষেপ নেই না কেন?
যাহোক পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পক্ষ থেকে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশ, নানান দাবি সম্বলিত লিফলেট, বুকলেট ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। আদিবাসীদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, ধর্ষণ, হত্যা হলে সরকার নিশ্চুপ ও বোবার মত ভূমিকা পালন করে থাকে। মনে হয় যেন আদিবাসী হত্যা করা হলে সরকার ও প্রশাসনের কোন দায় দায়িত্ব নেই। আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ করা হলে সরকার নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে। সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ভূমিকা দায়সারা ও নজিরবিহীন পক্ষপাতিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায়। খাগড়াছড়ি জেলায় বিজিবি ও বাঙালি গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় তাই ঘটলো।
আজ বর্ডার গার্ড বিজিবি ও বাঙালি গ্রামের মধ্যেকার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল, কয়েকজন গ্রামবাসীকে গুলি করে মারা হলো এবং বিজিবি বাহিনীর অন্যতম একজন সদস্যও জীবন দিলেন। ঘটনার বিবরণ যাইহোক কিন্তু একদিন পর পরই সেখান হতে সরাসরি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে নজিরবিহীন বলা যায়। অথচ সাজেকের বুকে কত মানুষ মারা গেলেন, প্রতিবাদ করলেন তারপর সরকারের টনক নড়েনি। গত ১৪ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়া বিজিবি বেছে বেছে আদিবাসী তঞ্চঙ্গ্যাদের উপর গুলি চালায়। এতে নিরীহ দুইজন তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসী নির্মমভাবে নিহত হন। কিন্তু সরকার বা বিজিবি কতৃর্পক্ষ দায়ি বিজিবি সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কথা বাদ, জাতীয় পর্যায়ের কোন মানবাধিকার সংগঠন সংগঠনও প্রতিবাদ করতে তেমন লক্ষ করা যায়নি। গণমাধ্যমগুলোও দায়ছাড়া গোচের সংবাদ প্রচার করে দায়িত্ব শেষ করেছিল।
গত ২২ আগষ্ট ২০১৮ তারিখে লামায় দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে দুই বিজিবি সদস্য কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনার কোন বিচার হয়নি। ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রশাসনের সহায়তায়বরঞ্চ ধর্ষণের শিকার দুই কিশোরীকে গ্রামবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আদিবাসীদের স্কুল তুলে দিয়ে সেখানে ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়, আদিবাসীদের বিহার মন্দির এর জায়গায় ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়, এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। “জোর যার মুল্লুক তার” সেনাবাহিনীর এধরণের হীন মানসিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে দিন দিন অস্থিতিশীল করে তুলছে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কিছু সেনা কর্মকর্তার মধ্যে উগ্রবাদী মনোভাব, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও মৌলবাদের ভূত চেপে বসে আছে। এই সাম্প্রদায়িক, উগ্র বাঙালি জাত্যাভিমানী ও মৌলবাদের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হওয়ার কারণে আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সেই হিংস্রতার আগুন পোহাতে হচ্ছে। সেজন্য বারবার প্রিয় পাহাড়ের বুকে এই সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এর কারণে বলির পাঁঠা হচ্ছে শতশত পাহাড়ী আদিবাসী।
আরও উল্লেখ্য যে, বিজিবি গুইমারা অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জি এইচ এম সেলিম হাসান জানান, ‘মূলত নিরাপত্তার কারণেই গাজীনগর বিজিবি ক্যাম্পটি অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ এলাকাবাসীর নিরাপত্তা স্বার্থে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের কারণে বিজিবি ক্যাম্পটি স্থাপিত হয়েছিল। এখন প্রচার করা হচ্ছে মূলত নিরাপত্তার কারণেই বিজিবি ক্যাম্পটি অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এযাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে শতশত সেনাক্যাম্প, বিজিবি ক্যাম্প আদিবাসীদের জায়গা বেদখল করে স্থাপিত হয়েছিল, এর কারণে অনেক আদিবাসী জুম্ম মারাও গিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন, কিন্তু কোনদিন চোখে পড়েনি সে জায়গা হতে বিজিবি ও সেনাক্যাম্প অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম আদিবাসীদের বেলায় তা কখনো হবে না, কিন্তু বহিরাগত সেটেলার মুসলমান বাঙালিদের বেলায় তা হবে। আমরা আদিবাসী হতে পারি, আমরা সংখ্যা দিক দিয়ে কম হতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের জাতি বৈচিত্র্যময় দেশ প্রমাণ করতে হলে আমাদের আদিবাসীদের অবশ্যই লাগবে। আদিবাসীদের ছাড়া জাতি বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের ফুলের বাগান কখনো পরিপূর্ণ হবে না।
আদিবাসীরাও বাংলাদেশকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বহু জাতি বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচয় করে দিতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রতি কেন এতো অবজ্ঞা, অবহেলা? আমাদের প্রতি কেন এতো বঞ্চনা আর চরম বৈষম্যের আচরণ করা হবে? আমরাও তো মানুষ, মানুষের পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার আমাদেরও অধিকার রয়েছে। আমাদের আদিবাসীদের প্রতি এতো অমানবিক আচরণই বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে। আমরা এখনও পাহাড়ে পাহাড়ে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” এই জাতীয় সংগীত গানটি গেয়ে চলি। “এক সাগর রক্তের বিনিময় বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা” আমরা তাদের এখনো ভুলিনি। বাংলাদেশের প্রতি যতটা শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ করা দরকার ঠিক ততটাই আমাদের আদিবাসীদের মধ্যে অটুট রয়েছে। আমরা আদিবাসীরা এখনো ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, বাংলার স্বাধীনতাকে সবার উর্ধ্বে তুলে ধরি। তারপরও আমাদের প্রতি এতো শোষণ, বৈষম্য ও চরম বর্ণবাদী আচরণ কেন করা হচ্ছে? আদিবাসীদের গ্রামে সংঘর্ষে মানুষ মারা গেলেও সেনাক্যাম্প ও বিজিবি ক্যাম্প অস্থায়ীভাবে কোনদিনই সরিয়ে নেওয়া হয়নি, কিন্তু গত ৩ মার্চ ২০২০ ইং বাঙালিদের গ্রামে সংঘর্ষে বাঙালি মারা যাওয়ার একদিন পর সেই এলাকা হতে বিজিবি ক্যাম্পটি গুটিয়ে নেওয়া হল। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই বর্ণবাদী আচরণই আমাদের পীড়া দেয়, আমরা গভীর যন্ত্রণা অনুভব করি।
খাগড়াছড়ি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এই ঘটনা তদন্তের জন্য তাদের কাজ শুরু করেছে। যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং গ্রামবাসীসহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিজিবির দিক থেকে কোনও গাফিলতি ছিল কিনা তা গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে।’ এই ঘটনার তদন্ত কমিটির মধ্যে একটা স্ফীত লক্ষ্য করা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছিল, সেনাক্যাম্প ও বিজিবি ক্যাম্প সম্প্রসারণ নিয়ে অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। সাজেকের বাঘাইহাট, দীঘিনালা বাবুছড়া, রাঙ্গামাটি লংগদু, খাগড়াছড়ি মহালছড়ি, নানিয়াচর উপজেলার মধ্যে অনেক সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যা, লুটপাট এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আমরা ততটা স্ফীত লক্ষ্য করিনি যতটা খাগড়াছড়ি জেলার বাঙালি এলাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্ত কমিটির স্ফীত চোখে পড়ার মতো। ঘটনার একদিন যেতে না যেতে এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ার আগে বিজিবি ক্যাম্পটি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নজিরবিহীন ঘটনা বলা যায়। প্রিয় পাঠক আপনারা আমাকে বলতে পারেন, এতো রং মিশিয়ে লেখাটা কি ঠিক? অবশ্যই ঠিক! কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অনেক অনেক স্থানে এর চেয়েও বেশি এধরণের ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল, কোন স্থান হতে এধরণের ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলতে পারেন? না, সরিয়ে নেওয়া হয়নি বরং আদিবাসীদের চরম ক্ষতি হওয়ার পরেও সেনাক্যাম্প ও বিজিবি ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়নি আরও অধিকতর শক্তিশালী করা হয়েছে। তাইতো আজ রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সাম্প্রদায়িক সামরিক আমলা কর্মকর্তাদের বর্ণবাদী আচরণ নিয়ে লিখতে বসেছি। বাংলাদেশের পবিত্র মহান সংবিধান ও স্বাধীনতাকে এরা ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে।
আমি শাসকগোষ্ঠীর বর্ণবাদী আচরণের কথা কিছু তুলে ধরেছি, আরও সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে চলেছি। কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি গাত্রবর্ণের কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বৈষম্যমূলক আচরণের নীতিকেই বর্ণবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের মধ্যেই বর্ণবাদ সীমাবদ্ধ নয়; বরং শ্রেণী, জাতি, দেশ ও ধর্ম বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেও এমনটি পরিলক্ষিত হয়। বর্ণবাদ সমাজ শোষণের এক অন্যতম হাতিয়ার। যে হাতিয়ার দ্বারা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত। বর্ণবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি, যা নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য কোনো গোষ্ঠী উচুঁ অথবা নিচু; কোনো গোষ্ঠী বেশি যোগ্য অথবা অযোগ্য; কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে উগ্র বাঙালি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের আচরণের দরুনই জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ ক্ষতবিক্ষত ও বিলুপ্তপ্রায় আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তখনি তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। খাগড়াছড়ি জেলায় বিজিবি আর গ্রামবাসীর সংঘর্ষ ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ। আমরা জানি, পৃথিবী ব্যাপী সবচেয়ে বেশি বর্ণবৈষম্য তথা অবহেলিত, নির্যাতিত, পদদলিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত ও গায়ের রং দিয়ে অর্থাৎ কালো আর সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল। বর্ণবাদ শুধু গায়ের চামড়ার রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনো পেশা দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। তার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিই বলে দেয় সে অসাম্প্রদায়িক নাকি সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী।
গায়ের রঙ দিয়ে বর্ণবাদ সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বোধহয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর পেশার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- ব্রাহ্মণ- বৈষ্ণব, বৈষ্ণব- শূদ্র এভাবে পেশার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের বর্ণভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্ণবাদের কথা উঠলেই এসে যায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কৃষ্ণাঙ্গ নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার কথা। যিনি ২৭ বছর কারাবাস করেন। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রতি হন এবং শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, সামরিক ও বেসামরিক আমলা সকলেই যেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে মনে রাখে। যেই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি বর্ণবাদী আচরণ করেছিল, দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে রেখেছিল তার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে যাতে অনুসরণ না করে, বরং বর্ণবাদবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ যেই মানুষটি করেছিল, নিপীড়িত মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকেই অনুসরণ করুক এটায় প্রত্যাশা করি। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে একটু চোখ বুলাই, সেখানে বর্ণবাদবিরোধী গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে তখন বর্ণবাদী সরকার কঠোর হাতে দমন পীড়ন গ্রেফতার ও গুলি চালিয়ে আন্দোলনকে দমন করার ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়েছিলো। সেখানকার বর্ণবাদবিরোধী সরকার আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক চাপের মূখে অনেক বর্ণবৈষম্যেমূলক আইন বাতিল করতে বাধ্য হন। ১৯৯৩ সালে কৃঞ্চাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ ২১টি রাজনৈতিক দল বর্ণবাদের অবসান এবং সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি নতুন সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকার করে। তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের নির্মম উৎপীড়ন ও নির্যাতনের কালরাত্রির দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে জন্ম হয় আফ্রিকার বুকে এক নতুন জাতির। বাংলাদেশ আমার প্রিয় মাতৃভূমি একদিন যেন তাই হয়।
স্বাধীনতার পর হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাশাসন, সেনা নির্যাতন চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরও অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যোগ হয়েছে ক্রসফায়ারের নামে জুম্ম বিদংশী ষড়যন্ত্র। যেকোন একটা মামলায় অভিযুক্ত করে ঘরবাড়িতে তল্লাসী অভিযান চালিয়ে সাধারণ আদিবাসীদের ধরে নিয়ে যাবে এবং কয়েক ঘন্টার পর সন্ত্রাসীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধ সাজিয়ে ক্রসফায়ারের গুলি করে মেরে ফেলবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম আদিবাসীদের বিলুপ্ত করার শাসকগোষ্ঠীর নতুন কৌশল হিসেবে ক্রসফায়ারকে কাজে লাগানো হচ্ছে। শাসকশ্রেণি এ দায় কখনো এড়াতে পারে না। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারী সাজিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে পাইকারী গ্রেপ্তার, একটা মামলা জামিন পাওয়ার পর সাথে সাথে আরেক টি সাজানো মামলায় অভিযুক্ত করে কারাগারে প্রেরণ ইত্যাদি চুক্তিবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্রসফায়ারের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার- বহির্ভূত হত্যাকান্ড জোরদার করা হয়েছে। বিগত নভেম্বর ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের বিধানাবলী লংঘন করে পার্বত্য অঞ্চলের তিন পার্বত্য জেলার আইন- শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ করবার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং র্্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন( র্্যাব) নিয়োগ করেছে। ইহা সম্পূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী কার্যক্রম। এতে করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জুম্মজনগণের মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে জুম্মজনগণের চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীকে দমন করা এবং আইন- শৃংখলা ও সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার অব্যাহত অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বস্তুতঃ আমরা বলতে পারি পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা, উন্নয়নসহ সকল বিষয় তত্বাবধান ও সমন্বয় করবে স্থানীয় সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনীরা। বিষয়টি হাস্যকর হলেও বাস্তব সত্য যে, চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন কার্যক্রমই চলছে না।
সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। মামলা করতে এতো বিলম্ব হল কেন? এতোক্ষণ আদিবাসী মানুষের দ্বারাই যদি একজন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিহত হতেন, তাহলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ মামলা অথবা রাষ্ট্রীয় মামলা করা হতো। সেই মামলার সূত্র ধরে নির্দোষ, নিরীহ সাধারণ আদিবাসীদের গ্রেফতার করা হতো। সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলতো পাহাড়ে পাহাড়ে। সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম করে দিতেন, প্রতিটি ঘরবাড়িতে তল্লাসী অভিযান চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতেন। জুম্ম জনগণ ঠিকমত চলাচল করতে পারতেন না, শান্তিতে ঘরবাড়িতে থাকতে পারতেন না। এখন বরং উল্টো দেখা যাচ্ছে, বিজিবি ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। হায়রে রাষ্ট্র এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় লুকিয়ে রাখি! তারপরও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সামরিক, বেসামরিক আমলাদের সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী আচরণ মুছে গিয়ে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন হয়ে আসুক। প্রতিনিয়ত চলছে আমাদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন। আমাদের জাতির উপর শাসকশ্রেণির বৈষম্যনীতি অব্যাহত রয়েছে।
দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পরও সেনাবাহিনী, আমলা ও সরকারের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে দিতে পারেনি। এক সময় আফ্রিকার বুকে শ্বেতাঙ্গরা যে বিভেদনীতি কৃঞ্চাঙ্গদের উপর প্রয়োগ করেছিল তা বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের পক্ষ থেকে ঘৃণিত হয়েছিল। এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি জাতি ও মানুষকে ধিক্কার জানাই। খাগড়াছড়ি জেলায় মাটিরাঙ্গা উপজেলায় বিজিবি ও বাঙালির অধ্যুষিত অঞ্চলের গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে, মৃত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আমিও এধরণের ঘটনার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাই, কিন্তু উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাসকগোষ্ঠীর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এটায় বাস্তব সত্য। এই ঘটনা হতে প্রমাণিত হয়েছে যে, শাসকগোষ্ঠী আদিবাসীদের অঞ্চলে সেনাক্যাম্প, বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ করতে গিয়ে আদিবাসীদের বিরোধীতার ফলে যদি আদিবাসীর প্রাণ চলে যায় তারপরও ক্যাম্প সরিয়ে নেবে না, কিন্তু বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে কোন ঘটনা ঘটলেই ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এবার স্পর্শ করে প্রশ্ন করতে পারেন, এটা কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব? এটা বর্ণবৈষম্য নয় কি? এটা সাম্প্রদায়িক বহিঃপ্রকাশ নয় কি? আরেকটি দিক না বললে নয়, আদিবাসীদের এধরণের ঘটনা ঘটলেই মেডিয়া, মানবাধিকার কমিশন, নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এবার এটাও প্রমাণিত হলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের এধরণের ঘটনা হলে সকলেই নড়েচড়ে উঠেন, বড়সড় করে প্রতিবাদ করেন এবং মেডিয়াও ফলাওভাবে প্রচার করে দেয়। হায়রে বর্ণবাদী সরকার, সাম্প্রদায়িক সরকার ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই তোমাকে। অত্যাচারী স্বৈরশাসকের বর্ণবাদী নির্মম উৎপীড়ন ও নির্যাতনের কালরাত্রির দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে যেন জন্ম হয় বাংলার বুকে এক নতুন জাতির। যে জাতি হবে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও গনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন পালনকারী। সকলের শুভ বুদ্ধি উদয় হোক, জুম্ম জাতির অধিকার ফিরে আসুক। নিপীড়িত মানুষের জয় হোক।
Comments
Post a Comment